• শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪২৮

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রে লজ্জায় অবনত গণতন্ত্র

হোয়াইট হাউসের ৪ কর্মকর্তার পদত্যাগ

  • মোমেনা আক্তার পপি
  • প্রকাশিত ০৮ জানুয়ারি ২০২১

মানতে রাজি নন জনগণের রায়। পরাজিত পার্টির একদল উগ্র সমর্থক দখল করে রেখেছে পার্লামেন্ট ভবন। আইনপ্রণেতারা প্রাণ বাঁচাতে ছুটছেন এদিক-সেদিক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে হামলাকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছে। নিহত হয়েছেন অন্তত ৪ জন। আতঙ্ক বিরাজ করছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। স্থানীয় সময় বুধবার বিশ্বের প্রধান গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে গোটাবিশ্ব। গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রের এমন অবমাননা কেউ মেনে নিতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার সমর্থকদের এহেন আচরণে লজ্জায় অবনত হয়ে পড়েছে গণতন্ত্র।

একে দুঃখজনক বলে বর্ণনা করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয় বলেছেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র নেতারা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে গণতন্ত্রের রোল মডেল যুক্তরাষ্ট্র। কারো কারো কাছে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস হচ্ছে গণতন্ত্রের মন্দির। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডে লাইয়েন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যার মূল হচ্ছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর। সেখানে এ ধরনের ঘটনা মানা যায় না। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ বলেছেন, ওয়াশিংটন ডিসিতে আজ যা হয়েছে, তা মোটেই যুক্তরাষ্ট্রের মতো নয়। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের শক্তিতেও বিশ্বাসী। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেয়। ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা. দাঙ্গা ও হতাহতের ঘটনা কলঙ্কজনক।

দেশটিতে বরাবরই নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে আসছে। কিন্তু সেখানে যেন কালিমা লেপে দিল ট্রাম্পের সমর্থকরা। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে ক্যাপিটাল ভবনে হামলা কয়েকশ বছরের মধ্যে নজিরবিহীন ঘটনা। ২শ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে এমন ঘটনা হয়নি।

ইউএস ক্যাপিটল হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৮১২ সালে যুদ্ধের পর এ প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন এমন আগ্রাসনের সাক্ষী হলো। ১৮১৪ সালে ওয়াশিংটনে অভিযান চালানের সময় ভাইস অ্যাডমিরাল স্যার আলেক্সান্ডার ককবার্ন ও মেজর জেনারেল রবার্ট রোসের নেতৃত্বে নির্মাণাধীন ক্যাপিটল ভবন আগুন জ্বালিয়ে দেয় ব্রিটিশ বাহিনী।

ইউএস ক্যাপিটল হিস্টোরিকাল সোসাইটি এক বিবৃতিতে বলে, ক্যাপিটল ভবন শুধুমাত্র একটি অবকাঠামো নয়। এটি তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র এবং আমাদের জীবনযাপনের মূর্ত প্রতীক। আমাদের দেশে আইনকানুন যথাযথভাবে মেনে চলা হয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর আমাদের সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। 

বুধবার দুপুরের পর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে নির্বাচনে জো বাইডেনের জয়ের স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলার সময় ট্রাম্পের শত শত সমর্থক ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। সহিংসতায় চার জন নিহত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয় পাল্টে দেওয়ার চেষ্টায় এ হামলা শুরু হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হোয়াইট হাউসের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে হোয়াইট হাউসের সহকারী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ম্যাট পটিঞ্জার, ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের দুই শীর্ষ সহযোগী স্টেফানি গ্রিশাম ও রিকি নিসেটাসহ হোয়াইট হাউসের চার শীর্ষ কর্মকর্তা রয়েছেন। 

ক্যাপিটলে নজিরবিহীন হামলার ঘটনা রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট  ডোনাল্ড ট্রাম্পের উসকানিতে ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ওবামা বলেন, ক্যাপিটলে আজকের সহিংসতার ঘটনা জাতির জন্য বড় ধরনের অসম্মান ও লজ্জার মুহূর্ত হিসেবে ইতিহাস ঠিক মনে রাখবে, যা উসকে দিয়েছেন একজন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট, যিনি একটি বৈধ নির্বাচনের ফল নিয়ে ভিত্তিহীনভাবে মিথ্যা বলে চলছেন।

বুধবার দুপুরের পর হামলাকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ক্যাপিটল ভবন কার্যত দখল করে নিলে অধিবেশন মুলতবি করতে বাধ্য হয় কংগ্রেস। পুলিশ পাহারা দিয়ে আইনপ্রণেতাদের সরিয়ে নেওয়া হয় আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলে। যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করা ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকেও পাহারা দিয়ে অধিবেশন কক্ষ থেকে বের নেয় পুলিশ। এরপর ক্যাপিটলকে ট্রাম্প সমর্থকদের দখলমুক্ত করতে পুলিশ অভিযান শুরু করে। পরের তিন ঘণ্টায় হলওয়েগুলো দিয়ে ট্রাম্প সমর্থকদের ছোটাছুটি ও বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে খোঁজাখুঁজি, হাঙ্গামা-বিশৃঙ্খলায় এক নজিরবিহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সহিংসতার মধ্যে গুলিতে এক নারী নিহত হন। পরে আরো তিনজনের মৃত্যুর খবর জানায় ওয়াশিংটন ডিসির পুলিশ। এফবিআই জানায়, তারা দুটি সম্ভাব্য বিস্ফোরক ডিভাইস নিষ্ক্রিয় করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে কারফিউ জারি করা হয়। শহরে ১৫ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দেন ডিসির মেয়র মুরিয়েল বাউজার।

ওই হাঙ্গামার পর পুলিশ অন্তত ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে; তাদের মধ্যে ৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কারফিউ ভঙ্গ করার জন্য। ৩ নভেম্বরের নির্বাচনকে ঘিরে কয়েক মাস ধরে ট্রাম্প যে বিভেদ সৃষ্টিকারী উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া হচ্ছিল ক্যাপিটলে হামলা তার চূড়ান্ত পরিণতি। ভোটে ব্যাপক কারচুপি করা হয়েছে বলে কোনো প্রমাণ ছাড়াই বার বার দাবি করে আসছিলেন ট্রাম্প এবং তার পরাজয় উল্টে দিতে তাকে সাহায্য করার জন্য সমর্থকদের আহ্বান জানাচ্ছিলেন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নির্বাচনের আগেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ট্রাম্প। ক্যাপিটলে হামলার আগে হোয়াইট হাউসের কাছে কয়েক হাজার সমর্থকের উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি। ভোট প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের ক্ষোভ জানাতে সমর্থকদের ক্যাপিটলের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে বলেন।  কর্মকর্তাদের নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করতে চাপ দেওয়ার জন্য তাদের বলেন তিনি, সমর্থকদের লড়াই করার আহ্বান জানান। দাঙ্গাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ক্যাপিটলের ভেতরে কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার করেন।

ওয়াশিংটন মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রধান রবার্ট কন্টি বলেন, আক্রমণকারীরা যন্ত্রণাদায়ক রাসায়নিক নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার একটু পরে ক্যাপিটল ভবন নিরাপদ বলে ঘোষণা করে পুলিশ। এরপর নির্বাচনী জয়ের স্বীকৃতির প্রক্রিয়া শুরু করতে রাত ৮টার পর আইনপ্রণেতারা অধিবেশন আবার শুরু করেন।  এরপর অধিবেশনের সভাপতিত্ব করা ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। বলেন, আজ যারা আমাদের ক্যাপিটলে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তারা জয়ী হতে পারবে না। চলুন আমরা কাজ শুরু করি। কংগ্রেস সদস্যরা হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দিত করেন। 

কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটর রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনল ঘটনাটিকে ব্যর্থ বিদ্রোহ আখ্যা দিয়ে অনাচার ও হুমকির কাছে মাথা নত করব না বলে  ঘোষণা দেন। আমরা আমাদের অবস্থানে ফিরে এসেছি। সংবিধানের অধীনে এবং আমাদের জাতির জন্য আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করব। আর আজ রাতেই আমরা তা করতে যাচ্ছি। বুধবার কংগ্রেস যৌথ অধিবেশনের বিরোধিতা করে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে জড়ো হয়েছিলেন কয়েক হাজার ট্রাম্প সমর্থক, যাদের মধ্যে উগ্রপন্থি বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যরাও ছিলেন। সে সমাবেশে বক্তব্যে নভেম্বরের নির্বাচনে পরাজয় মেনে না নেওয়ার ঘোষণা দেন ট্রাম্প।

সমাবেশ থেকে মিছিল নিয়ে গিয়ে কয়েকশ ট্রাম্প সমর্থক ক্যাপিটল ভবনের নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। এক পর্যায়ে কংগ্রেসের অধিবেশন চলার মধ্যেই পুলিশের বাধা ভেঙে ক্যাপিটল ভবনে ঢুকে পড়েন তারা। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদুনে গ্যাস ও পেপার স্প্রে ব্যবহার করে পুলিশ। ট্রাম্প সমর্থক কয়েকজন আইনপ্রণেতার নির্বাচনের ফল বাতিলের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলার মধ্যেই সেখানে গোলযোগের সৃষ্টি হয়।

এ সময় পুলিশ অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত আইনপ্রণেতাদের তাদের আসনের নিচ থেকে গ্যাস মাস্ক বের করে পরার পরামর্শ দেয়। মিশিগানের কংগ্রেস সদস্য হ্যালি স্টিভেন্স টুইটে লিখেছেন, আমি আমার অফিসের এক জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছি। বিশ্বাস করতে পারছি না যে, এটা আমাকে লিখতে হচ্ছে। ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র মিউরিয়েল বাউজার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শহরজুড়ে কারফিউ জারি করেন। ক্যাপিটল পুলিশকে সহায়তা করতে কংগ্রেস ভবনে ন্যাশনাল গার্ডের সেনা, এফবিআই এজেন্ট এবং  সিক্রেট সার্ভিস সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। কারফিউ শুরু হওয়ার পর ন্যাশনাল গার্ড সেনা ও পুলিশ প্রতিবাদকারীদের ক্যাপিটলের আশপাশ থেকে সরিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads